
যুদ্ধের শঙ্কা ছায়া ফেলছে ফিলিপাইনের উত্তর প্রান্তের বাতানেস দ্বীপপুঞ্জে। ২০২৩ সালের এপ্রিলের এক সকালে ৬৫ বছর বয়সী মারিলিন হুবাল্ডে প্রথম শুনেছিলেন আকাশ কাঁপানো সামরিক হেলিকপ্টারের গর্জন। যৌথ মহড়ার জন্য ফিলিপিনো ও মার্কিন সেনারা দ্বীপে নামছে, এমন দৃশ্য দেখেই আতঙ্কে কেঁপে ওঠে স্থানীয়রা।
দ্বীপের বাসকো শহরের দোকান মালিক হুবাল্ডে বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম বাতানেসে সামরিক মহড়া চলছে জেনে চীন আক্রমণ করেছে।
আমার গৃহকর্মী মাঠে কাজ করছিলেন, তিনিও ভয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়েন। ভেবেছিলেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।’
এর পর থেকে প্রায় ২০ হাজার মানুষের এই প্রদেশে যুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক মহড়া নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। এ বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইন সেনারা দুই দফা বিমানযোগে বাতানেসে অ্যান্টি-শিপ মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন করে মহড়া চালায়।
একসময়ের শান্তিপূর্ণ এই দ্বীপপুঞ্জ এখন হয়ে উঠছে মার্কিন-চীন ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফ্রন্ট-লাইন। তাইওয়ান থেকে মাত্র ১৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাতানেস জুড়ে আছে বাশি চ্যানেল নামের এক গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথের ওপর, যা দক্ষিণ চীন সাগরকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
‘বাশি চ্যানেলই হতে পারে যুদ্ধের মেরুদণ্ড’
রয়টার্সের অনুসন্ধানে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইন যৌথভাবে এই এলাকাকে ব্যবহার করতে চায় চীনা নৌবাহিনীর গতিপথ রোধে। চীন যদি তাইওয়ানে হামলা চালায় তাহলে ভূমি থেকে উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত অ্যান্টি-শিপ মিসাইল দিয়ে বাশি চ্যানেল অচল করে দেওয়াই তাদের মূল পরিকল্পনা।
ফিলিপাইন নৌবাহিনীর সাবেক উপপ্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল রোমেল অং বলেন, ‘যদি আমরা চীনকে বাশি চ্যানেলের নিয়ন্ত্রণ নিতে না দিই, তবে সেটাই হবে যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারণকারী মুহূর্ত।’
আর সাবেক সেনাপ্রধান ইমানুয়েল বাউটিস্তার মতে, ‘উত্তর ফিলিপাইনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া তাইওয়ান আক্রমণ কার্যত অসম্ভব।’
চীন অবশ্য বারবার বলছে, তাইওয়ান তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না। বেইজিং ফিলিপাইনকে সতর্ক করেছে ‘বাহ্যিক শক্তিকে টেনে এনে উত্তেজনা সৃষ্টি না করতে।’
মার্কিন প্রতিরক্ষা কৌশলে ফিলিপাইন এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
দেশটির হাজারো দ্বীপ সারিবদ্ধভাবে তৈরি করেছে ‘প্রথম দ্বীপ শৃঙ্খল’, যা জাপান থেকে শুরু হয়ে তাইওয়ান ও ফিলিপাইন হয়ে বরনিও পর্যন্ত বিস্তৃত।
এই দ্বীপমালা কার্যত চীনের উপকূলীয় জলসীমাকে ঘিরে রাখে, এবং মার্কিন সেনারা চায় এই ‘চেইন’ ব্যবহার করে চীনের গতিবিধি সীমিত রাখতে।
ফিলিপাইন নৌবাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল রয় ত্রিনিদাদ বলেন, ‘দক্ষিণ চীন সাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে আমরা ঈশ্বর প্রদত্ত এক প্রাকৃতিক গেটকিপার।’
১৯৯২ সালে ফিলিপাইন সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সুবিক বে ঘাঁটি ছাড়তে বাধ্য করেছিল। কিন্তু তিন দশক পর আমেরিকান সৈন্যরা আবার ফিরে এসেছে।
রয়টার্স জানায়, বর্তমানে ফিলিপাইনে শুধু ২০২৬ সালেই ৫০০টিরও বেশি যৌথ সামরিক অনুশীলনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ কংগ্রেসে জানান, তাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে প্রথম সারির দ্বীপগুলোতে চীনা আগ্রাসন প্রতিরোধে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
চীন এখন শুধু দক্ষিণ চীন সাগরেই নয়, উত্তরের বাতানেস অঞ্চলেও ‘গ্রে-জোন’ বা সীমারেখার নিচে যুদ্ধকৌশল ব্যবহার করছে। গত আগস্টে ফিলিপাইন নৌবাহিনী একাধিক চীনা যুদ্ধজাহাজ বাতানেসের কাছে অননুমোদিত অনুপ্রবেশ শনাক্ত করেছে এবং তাদের চ্যালেঞ্জ করার দাবি করেছে।
ফিলিপাইন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, চীনের এসব পদক্ষেপ ‘আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন’ এবং তাদের বৈশ্বিক আধিপত্য স্থাপনের প্রচেষ্টার অংশ।
যুদ্ধের প্রস্তুতি ও আতঙ্ক
বেইজিং যদি তাইওয়ান আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয় তবে এই দ্বীপপুঞ্জগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই বছরের শুরুর দিকে কিছু মহড়া থেকে জানা যায় যে ম্যানিলা এবং ওয়াশিংটনের সামরিক পরিকল্পনাকারীরা ধারণা করছেন, তাইওয়ানের উপর আগ্রাসন শুরু হলে চীন ভৌগোলিক সুবিধা পেতে বাতানেস আক্রমণ বা দখল করার চেষ্টা করতে পারে।
মহড়া নিয়ে স্থানীয় মানুষ আতঙ্কে আছেন জানিয়ে দ্বীপের বাসিন্দা মারিলিন হুবাল্ডে বলেন, ‘২০২৩ সালের মহড়ার সময় আমি সঙ্গে সঙ্গে চাল, তেল, চিনি মজুদ করেছিলাম। সবাই ভয় পেয়েছিল যে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।’
