
চট্টগ্রাম বন্দরের ৪১ শতাংশ বর্ধিত ট্যারিফ পুনর্বিবেচনার দাবিতে এবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে চিঠি দিয়েছেন চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজার্স ফোরাম।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সংগঠনটির পক্ষ থেকে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে। ফোরামের আহ্বায়ক আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব স্টেকহোল্ডারের (স্থানীয় শিপিং এজেন্ট, আমদানি-রপ্তানিকারক, জাহাজ মালিক, ব্যবসায়ী সংগঠন) সঙ্গে পরামর্শক্রমে যৌক্তিক ও বাস্তবভিত্তিক ট্যারিফ কাঠামো নির্ধারণ করার জন্য সংগঠনটির পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ১৯৮৬ সালে সর্বশেষ ট্যারিফ কাঠামো প্রণয়নের সময় মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার বিনিময় হার ছিল ৩০.৬১ টাকা। বর্তমানে (২০২৫ সাল) এ হার ১২২ টাকা ছাড়িয়েছে অর্থাৎ বন্দরের বিদ্যমান ট্যারিফেই চারগুণের বেশি বেড়ে গেছে। এছাড়া গত কয়েক দশকে বন্দরের সার্ভিস ফি, হ্যান্ডলিং চার্জ, পাইলটেজ, ডেমারেজ ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে ট্যারিফ ধাপে ধাপে বেড়েছে। ফলে বর্তমানে অতিরিক্ত বড় পরিসরে ট্যারিফ পুনর্র্নিধারণ করলে তা আমদানি-রপ্তানির ব্যয় বহুলাংশে বাড়িয়ে দেবে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর একটি সেবা প্রদানকারী সংস্থা, কোনো বাণিজ্যিক লাভকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান নয়। বিদ্যমান ট্যারিফ আদায়ের মাধ্যমেই বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করার পরও বিপুল পরিমাণ অর্থ তাদের সংরক্ষিত তহবিলে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মাসুল বৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দরে যেসব ট্যাংকার, বাল্ক কার্গো, কনটেইনার ও অন্যান্য জাহাজ আগমন করে- সেগুলো দেশের জ্বালানি, খাদ্যশস্য, শিল্প কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য পরিবহণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কার্যক্রমের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক প্রিন্সিপালদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিসমূহ। যেগুলোর ভিত্তি বিদ্যমান ট্যারিফ কাঠামো। ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মধ্যে আস্থা হ্রাস পাবে এবং চট্টগ্রাম বন্দর আন্তর্জাতিকভাবে একটি অনিশ্চিত ও ব্যয়বহুল গন্তব্য হিসেবে চিহ্নিত হবে।
ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে সেগুলো হলো- রপ্তানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে কনটেইনার হ্যান্ডলিং, স্টোরেজ এবং পরিবহণ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে; যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকবে। আমদানি পণ্যের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে জ্বালানি, গম, সার ও শিল্প কাঁচামালের ক্ষেত্রে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব দেশের মূল্যস্ফীতির ওপর পড়বে। আন্তর্জাতিক শিপিং কমিউনিটির মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের গ্রহণযোগ্যতা ও আস্থা কমে যাবে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন একটি অবকাঠামোগত সেবা প্রতিষ্ঠান। এর কার্যক্রম পরিচালিত হওয়া উচিত ‘খরচ ও পরিষেবা ভিত্তিক’ মডেলে। তাই কেবল রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য ট্যারিফ বাড়ানো সমর্থনযোগ্য নয়। পাশাপাশি দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ সূচক (ব্যবসা করার সহজতা) এবং আন্তর্জাতিক লজিস্টিকস পারফরম্যান্স ইনডেক্সেও এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করে চিঠিতে বলা হয়- প্রস্তাবিত নতুন ট্যারিফ বাস্তবায়ন আপাতত স্থগিত রাখা হোক এবং বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য একটি সময়োপযোগী পর্যালোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে যৌক্তিক ও বাস্তবভিত্তিক ট্যারিফ কাঠামো নির্ধারণ করা হোক। বন্দরের কাঠামোগত উন্নয়ন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সেবাভিত্তিক এবং অলাভজনক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখা হোক।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়- চট্টগ্রাম বন্দর কেবল একটি বন্দর নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। এ বন্দর ঘিরেই গড়ে উঠেছে দেশের বৃহৎ রপ্তানি-আমদানি কার্যক্রম, শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়। তাই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেকোনো নীতিগত পরিবর্তন অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং জাতীয় অর্থনীতির ওপর সুদূরপ্রসারি প্রভাব ফেলতে সক্ষম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্রাম্প ট্যারিফ হ্রাসের জন্য সরকার এত আন্তরিকভাবে পরিশ্রম করেছে, সরকারের কৌশলী উদ্যোগ এবং সফল কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ স্বস্তির দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। অথচ দেশে যদি সেই ট্যারিফ পুনরায় সংযোজন বা আরোপ করা হয় তা হবে আমাদের রপ্তানি খাতের জন্য আত্মঘাতী। এ ধরনের পদক্ষেপ আমাদের অর্জিত সাফল্যকে ম্লান করে দেবে এবং শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন সেবা খাতে গড়ে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বা মাশুল বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। ১৪ অক্টোবর (মঙ্গলবার) রাত ১২টার পর থেকে বর্ধিত ট্যারিফ কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।