
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়। ওই দিন রাজধানী ঢাকার বিজয় সরণিতে স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতীক ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’-এর শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ‘মৃত্যুঞ্জয়’ ভেঙে ফেলে ছাত্র-জনতা।
প্রায় ১০ মাস পর সেই ভাস্কর্য ঘিরে থাকা বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রামের নানা অধ্যায়ের ম্যুরালসংবলিত সাতটি দেয়ালও ভেঙে ফেলেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এবার সেই জায়গায় নির্মাণ করা হবে জুলাই শহীদদের স্মরণে ‘গণমিনার’।
ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট মুজিবের ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। এটা এভাবে ফেলে রেখে কোনো লাভ নাই, সেখানে নতুন কিছু যদি করা যায়। সে জন্য আমরা আগে জায়গাটা পরিষ্কার করছি। সেখানে কী করা যায়, আমরা চিন্তা করে দেখব।’
স্থানটিতে জুলাই স্মরণে ‘গণমিনার’ করা হচ্ছে কি না—জানতে চাইলে এজাজ বলেন, সেখানে নয়, তার পাশে সবুজ স্থানটিতে করা হবে।
২০২১ ও ২০২২ সালে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে ‘মৃত্যুঞ্জয়’ নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য প্রদর্শিত হয়। পরে ওই ভাস্কর্য স্থাপন করা হয় ঢাকার বিজয় সরণিতে, ভাস্কর্য ঘিরে বাঙালির বিভিন্ন সংগ্রামী অধ্যায়ের ম্যুরাল দিয়ে গড়ে তোলা হয় ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’। ২০২৩ সালের ১০ নভেম্বর “মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’’ উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি দেশত্যাগ করেন। সেদিন দেশের বিভিন্ন ভাস্কর্যের মতো বিজয় সরণির মৃত্যুঞ্জয়ও ভেঙে ফেলা হয়।
এদিকে জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত গণপ্রতিরোধ ও আত্মত্যাগের স্মৃতি ধরে রাখতে সম্প্রতি ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’-এর জায়গায় ‘গণমিনার’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে ২০ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ‘গণমিনার বাস্তবায়ন কমিটি’। ওই সংবাদ সম্মেলনে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন ১ হাজার ৪০০ মানুষ, আহত হয়েছেন হাজার হাজার। তাঁদের স্মরণেই নির্মিত হবে “গণমিনার’’।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই উদ্যোগে গণমানুষের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে গণচাঁদা সংগ্রহের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। আগামী ৫ আগস্টের মধ্যে এই মিনারের একটি প্রাথমিক দৃশ্যমান রূপ দিতে চায় গণমিনার বাস্তবায়ন কমিটি। পুরো বিজয় সরণি ধরেই তাঁদের এই পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে।
ডিএনসিসি সূত্রে জানা যায়, ২৫ জুন ডিএনসিসির সপ্তম করপোরেশন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’-এ জুলাই শহীদদের স্মরণে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ ও একটি উন্মুক্ত স্থান তৈরি করা হবে। এরই মধ্যে একটি কনসেপ্ট তৈরি করা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে বিস্তারিত জানা যাবে।
এই সিদ্ধান্তের পরই গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে বিজয় সরণির ওই ভাস্কর্য ঘিরে বানানো ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’-এর সাতটি দেয়াল ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হয়। আজ বিকেল পর্যন্তও সেখানে ভাঙার কাজ চলতে দেখা যায়।
আজ দুপুরে বিজয় সরণি গিয়ে দেখা যায়, মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ নামের ভাস্কর্যের দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে চট দিয়ে ডেকে রাখা হয়েছে। ভেতরে ভার্স্কযের প্রায় সব দেয়াল ভাঙা। ভাঙা কনক্রিটের মাঝেই লোহার রডগুলো এখনো পড়ে রয়েছে। ভাঙার কাজে ব্যবহার করা একটি ভেকু সেখানে রাখা আছে। চারজন শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন। কেউ ইট সরাচ্ছেন, কেউ ভাঙা রড বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে জড়ো করছেন।
তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের কাজ করার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। বাইরের কেউ যেন কোনো মালপত্র নিয়ে যেতে না পারে, তার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করবেন আর পাহারা দেবেন।
সেখানে কাজ করতে আসা রবিউল ইসলাম নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘আমাদের কাজ করার জন্য নিয়ে এসেছে। সকাল থেকে এখানে যেসব রড রয়েছে, সেগুলো একত্র করলাম। আর পাহারা দিচ্ছি যেন কেউ কোনো কিছু নিতে না পারে।’
মো. খালেক নামের আরেকজন বলেন, ‘দিনমজুর হিসেবে আমরা কাজ করি। আমাদের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে নিয়ে আসছে। এর বাইরে আমরা আর কিছু জানি না।’
কাজ করতে নিয়ে আসা ও পাহারা দেওয়ার জন্য বলা হলেও এ সময় এক ব্যক্তিকে কিছু রড হাতেও নিয়ে যেতে দেখা যায়। ভাঙা ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে দেখছিলেন কেউ কেউ। এ সময় মো. বকুল নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘এক সরকার গড়বে, আরেক সরকার এসে ভাঙবে। এসব ভাঙাভাঙির কাজ কী। এমন কিছু করুক, যাতে কেউ আর না ভাঙে।’
ভাস্কর্য ভাঙার তদারক করছে ডিএনসিসি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেখানে দায়িত্বরত সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ভাস্কর্যটি ভাঙার টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। তারা তাদের লোক দিয়ে ভাঙার কাজ করছে। আমরা এখানে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করছি। কোনো কিছু যেন কেউ নিয়ে যেতে না পারে, সেটার দেখভাল করছি।’
তবে প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষার পরও সেখানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাউকে পাওয়া যায়নি। ভাঙার কাজ সাবকন্ট্রাক্ট নেওয়া এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি তেমন কিছু জানেন না। তাঁকে শ্রমিক দিতে বলা হয়েছে, তিনি শ্রমিক দিয়েছেন—দিনে পাহারা ও কাজের জন্য। ভাঙার কাজ চলে রাতে।’