
তাদের কেউ আলো ছড়িয়ে গেছেন জীবনভর, কেউবা নিজ কর্ম-গুণে ছিলেন অনন্য। বেদনার সুর ছড়িয়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমালেও তাদের চিহ্ন চিরঅম্লান, চিরভাস্বর।
শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিক থেকে শুরু করে ২০২৪ সালে অনেক গুণীজনকে হারিয়েছে দেশ। নতুন বছর শুরুর আগে হারানো সেই মুখগুলো দেখে নেওয়া যাক একপলক।
রবীন্দ্রনাথ সরেন
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন মারা যান ১২ জানুয়ারি। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার বারোকনা গ্রামে নিজের বাড়িতে তার মৃত্যু হয়। ৬৬ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সরেন কিডনি ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ সরেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছাড়াও আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামে সহসভাপতি, কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন।
জাহিদুল হক
ষাটের দশকের কবি, গল্পকার, গীতিকার জাহিদুল হক মারা যান ১৫ জানুয়ারি। সংগীত শিল্পী সুবীর নন্দীর কণ্ঠে তার লেখা ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’ গানটি দেশজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
জাহিদুল হক বাংলা কবিতায় যুক্ত করেছিলেন নতুন মাত্রা। উচ্চকণ্ঠের বিপরীতে সংবেদী অথচ সবল উচ্চারণ তাকে বাংলা কবিতাভুবনে বিশিষ্ট স্থান দান করেছিল। কবিতা ছাড়াও প্রবন্ধ, গল্পে তিনি ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ।
সৈয়দ কামাল উদ্দিন আহমেদ
ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ সম্পাদক, প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ কামাল উদ্দিন আহমেদ মারা যান ৫ মার্চ। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
সৈয়দ কামাল উদ্দিনের সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৯৬১ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকার মাধ্যমে। বিভিন্ন দৈনিকে তিনি কাজ করেছেন। সর্বশেষ ২০০৫ সালে তিনি হলিডে পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।
২০০১ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশনে প্রেস মিনিস্টার ছিলেন তিনি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে কাজ করা এ সাংবাদিক জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন।
ইহসানুল করিম
জাতীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক ইহসানুল করিম মারা যান ১০ মার্চ। ৭৩ বছর বয়সী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব। তার আগে ছিলেন রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা করেন ইহসানুল করিম। পরে ভারতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ)-এর সদস্য হিসেবে পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন।
সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবনে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ছাড়াও বিবিসি, পিটিআইসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বাংলাদেশ প্রতিবেদক হিসেবেও কাজ করেছেন ইহসানুল করিম।
গোলাম আরিফ টিপু
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু মারা যান ১৫ মার্চ। ৯৩ বছর বয়সী এই আইনজীবী দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন।
১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা টিপু রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের রাজশাহী অঞ্চলের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে ২০১৯ সালে একুশে পদক দেওয়া হয়।
গোলাম আরিফ টিপু ১৯৫৮ সালে আইনজীবী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি একাধিকবার রাজশাহী আইনজীবী সমিতির সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন।
সাদি মহম্মদ
১৩ মার্চ মারা যান দেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ। নিজের ঘরে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ পাওয়া যায়।
শহীদ সলিম উল্লাহর ছেলে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। তিনি ছিলেন একাধারে শিল্পী, শিক্ষক ও সুরকার। তার ভাই শিবলী মোহাম্মদ দেশের জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী।
২০০৭ সালে ‘আমাকে খুঁজে পাবে ভোরের শিশিরে’ অ্যালবামের মাধ্যমে তিনি সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সাদি। ২০০৯ সালে তার ‘শ্রাবণ আকাশে’ ও ২০১২ সালে তার ‘সার্থক জনম আমার’ অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি তাকে রবীন্দ্র পুরস্কার দেয়।
খালিদ
চাইম ব্যান্ডের শিল্পী খালিদ মারা যান ১৮ মার্চ । ‘কোনো কারণে, কোনো কারণেই ফেরানো গেলোনা তাকে, ফেরানো গেলোনা কিছুতেই.. সে যে হৃদয় পথের রোদে একরাশ মেঘ ছড়িয়ে হারিয়ে গেল নিমিষেই’- গানের কথাগুলোর মতই হারিয়ে গেলেন তিনি।
গোপালগঞ্জে জন্ম নেওয়া এই শিল্পী ১৯৮১ সালে গানের জগতে যাত্রা করেন। ১৯৮৩ সালে যোগ দেন ‘চাইম’ ব্যান্ডে।
তিনি চাইম ব্যান্ডের ভোকালিস্ট হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। ‘সরলতার প্রতিমা’, ‘যতটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে’, ‘কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে’, ‘হয়নি যাবারও বেলা’, ‘যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে’, ‘তুমি নেই তাই’ এমন বহু শোতাপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এ শিল্পী।
কুমুদিনী হাজং
ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের সাক্ষী নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলার কুমুদিনী হাজং ২৩ মার্চ মারা যান।
লড়াই-সংগ্রামের জীবন্ত কিংবদন্তি কুমুদিনী হাজং। সংগ্রাম করেছেন ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে। কুমুদিনী হাজংকে ঘিরেই সেদিন ছড়িয়ে পড়েছিল টংক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ।
জমিদারদের অন্যায্য খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে সেই সময় রাজ সেনার বিরুদ্ধে তিনি কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৫০ সালে বাতিল হয় টংক প্রথা।
জিয়া রহমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক জিয়া রহমান মারা যান ২৩ মার্চ। তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
অধ্যাপক জিয়া রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন।
গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলায় জন্ম নেওয়া জিয়া রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করে কানাডায় উচ্চতর ডিগ্রি নেন। শিক্ষকতা জীবনের শুরুতে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। ১৯৯৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
অধ্যাপক জিয়া রহমান ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব ক্রিমিনোলজির বোর্ড ডিরেক্টর ছিলেন। এছাড়া তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সোশ্যাল সায়েন্সের ডিরেক্টর ছিলেন।
